নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
ভারতবর্ষের মাটিতে বেড়ে ওঠা সংস্কৃতি আর জন্ম নেওয়া সনাতন(হিন্দু), বৌদ্ধ, জৈন, শিখ ইত্যাদি ধর্ম সমূহের আচার-অনুষ্ঠান সহোদরই বটে । আর এজন্যই অধুনা এক শ্রেণীর অতি সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী আমাদের বাঙালী সংস্কৃতিকে হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি বলতেও ছাড়ে না। কাজেই এ মাটির আদি বা লোকসংস্কৃতির আলোচনায় সনাতন(হিন্দু) ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের কথা অনিবার্য ভাবেই উঠে আসে।
১৯৮০-৮৫ সালেও দেখেছি– জোড়া সানাই জোড়া ঢাক নিয়ে গম্ভীরা খেলার কতো দল, খেলা শেষে চড়ক পূজা । দলে দলে পীর খেলা, শেষে পীর পূজা । অমাবস্যায় দীপাবলির পরদিন থেকে চোর-চুন্নি খেলার কতো দল , আষাঢ়ের অনাবৃষ্টিতে হুচাই, হুদুমা-হুদুমি খেলার কি প্রচলন , জন্মাষ্টমীতে পাড়ায় পাড়ায় কাদো খেলার মহোৎসব , দোল পূর্নিমার পরদিন থেকে পাড়া ঘুরে ঘুরে দলে দলে কীর্তন আর রঙ খেলা । কালীপূজো লক্ষ্মীপূজোর পরে অনিবার্য ভাবে মাটিয়া গান, যাত্রা গান সপ্তাহ বা কোথাও মাসব্যাপী ।
যেখানে ছিল ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল সাধারণ মানুষের অংশ গ্রহণ । ছিল না সাম্প্রদায়িক ভেদা-ভেদ, ভিন্ন সম্প্রদায় অর্থাৎ মুসলমান ভাইয়েরাও আয়োজন থেকে শুরু করে সব কিছুতেই করতেন সক্রিয় অংশ গ্রহণ। ছিল প্রাণের নিবিড় বন্ধন।
এসব আজ বিলুপ্তির পথে । একবার ভেবে দেখি এসব আচার-অনুষ্ঠান-উৎসবে কতটা যোগ ছিল লোকসংস্কৃতির, কতোটা যোগ ছিল অসাম্প্রদায়িকতার! ছিল না বিন্দু মাত্র বানিজ্যিকতা!
এখন বৃহৎ ভাবে শুধু নিরেট অসাম্প্রদায়িক উৎসব হিসেবে শারদীয় দুর্গাপূজাই বেঁচে আছে মাত্র। যদিও সনাতন(হিন্দু) ধর্মীয় অনুষ্ঠান মানেই অনেকাংশেই উদার ও অসাম্প্রদায়িক।
সম্প্রতি সনাতন(হিন্দু) ধর্মীয় প্রধানতম অনুষ্ঠান হিসেবে দাঁড় হয়েছে নামযজ্ঞানুষ্ঠান । নামযজ্ঞ অনুষ্ঠানও অসাম্প্রদায়িক বটে কিন্তু এ আজ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হলেও বড় বেশী বানিজ্যিক ।
আগে কীর্তনদলকে দিতে হতো না এমন উঁচু দরের পারিশ্রমিক, প্রয়োজন হতো না দেশী-বিদেশীএমন বানিজ্যিক দল, এমন দামী ডেকোরেশন, দামী সাউন্ড সেট কিংবা এমন রঙ-বেরঙের বাহারি লাইটিং ।
আগের নামযজ্ঞ অনুষ্ঠান মানে এ পাড়ার ও পাড়ার দল, না ছিল লাইটিং, না ছিল ডেকোরেশন, সাউন্ড সেট । রাতের আঁধার কাটতে ছিল হারিকেন বা বড় জোড় হেচাক লাইট । দেওয়া হতো কোনো রকম আচ্ছাদন, ছিল একটু খিচুড়ি প্রসাদ, দলের জন্য পাঁচ-দশটি টাকা আর একখানা শ্রীমদ্ভাগবত গীতা ।
প্রয়োজন হতো না আয়োজক কতৃপক্ষের এমন দলে-দলে গ্রামে-গ্রামে, শহরে-বাজারে আত্মীয় অনাত্মীয়র বাড়ীতে, দূর-দূরান্তে বস্তা আর রশিদ বই । চাঁদা চাঁদা চাঁদা আর চাঁদা, শ্রোতা সাধারণের উপরেও চাঁদা ।
শুধু সনাতন(হিন্দু) ধর্মীয় অনুষ্ঠানেই কেন মুসলমান ভাইদের ওয়াজ মাহফিলেও মোটা দামের হুজুর, উচ্চ মূল্যের ডেকোরেশন, সাউন্ড সেট, লাইটিং ইত্যাদি ইত্যাদি এবং চাঁদা চাঁদা চাঁদা ।
ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বা আচার-অনুষ্ঠান গুলি এখন ভাব-ভক্তি-প্রার্থনার চেয়ে অনেক অনেক বেশী অর্থ নির্ভর, ফ্যাশন নির্ভর। মঠ-মন্দির-মসজিদ-পূজা যেন চাঁদা চাঁদা আর চাঁদার সমার্থক।
ফিরে পাবো কি ঐ বিলুপ্তপ্রায় লোকসংস্কৃতি চর্চার অসাম্প্রদায়িক, বাণিজ্যবিহীন বিশুদ্ধ ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান গুলি???
লেখায়- শান্তিপদ রায়