প্লাস্টিক কুচি তৈরির কারখানায় কর্মসংস্থান হয়েছে হাজারো মানুষের।
নাসির উদ্দীন শাহ মিলন, নীলফামারী প্রতিনিধি।
দিন দিন মানুষের জিবনে অপরিহার্য হয়ে উঠেছে প্লাস্টিক ব্যবহার। খাবার থেকে শুরু করে ওষুধ, প্রসাধনী, প্রযুক্তি, নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য, সবক্ষেত্রেই মানুষ ব্যবহার করছে প্লাস্টিক পন্য। মানুষের জীবনের সাথে যেমন মিশে আছে প্লাস্টিক তেমনি এর অপব্যবহারে- সমুদ্র, নদী-নালা, খাল-বিল, পুকুর, প্রকৃতি দূষণের সবচেয়ে বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই পলিমার। বলা যায় এটি এখন ক্যান্সারে রুপ নিয়েছে প্রকৃতির। তবে বর্তমানে এই পরিত্যক্ত প্লাস্টিক, প্লাস্টিকের বিভিন্ন পন্য মেশিনে ভেঙে তৈরি হচ্ছে কুচি। আর এসব কুচি যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে। বিদেশেও রপ্তানি করে আয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা।
এদিকে যত্রতত্র পড়ে থাকা প্লাস্টিক, প্লাস্টিকের পন্য সংগ্রহের পর প্রক্রিয়াজাত করায় পরিবেশ দূষণ কমছে বলে দাবি সংশ্লিষ্টদের। এ ছাড়াও এসব কুচি তৈরির কারখানায় কর্মসংস্থান হয়েছে হাজারো মানুষের। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই খাতের আরও বিকাশ সম্ভব বলে জানান কারখানার মালিক ও শ্রমিকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নীলফামারী জেলায় প্রায় দুই শতাধিক ছোট-বড় প্লাস্টিকের কুচি তৈরীর কারখানা রয়েছে। আর এসব কারখানায় প্লাস্টিকের পুরানো বোতল, স্যালাইনের ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের কভার, সিরিঞ্জসহ বিভিন্ন প্লাস্টিকের পন্য মেশিনে ভেঙ্গে তৈরি করা হয় কুচি। এসব কুচি এখান থেকে সরবরাহ করা হয় দেশের বিভিন্ন বড় বড় প্লাষ্টিকের কারখানায়। বিদেশেও রপ্তানী করে আয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। প্রতিটি কারখানায় প্রতিদিন ৪০-৫০ জন শ্রমিক কাজ করেন।
সরেজমিনে জেলার কয়েকটি প্লাস্টিক কারখানায় দেখা গেছে, একদিকে ফেলে দেওয়া প্লাস্টিকের বোতল, ভাঙা প্লাস্টিক বর্জ্য স্তূপ করে রাখা হচ্ছে। অন্যদিকে প্লাস্টিক কুচি শুকাতে ব্যস্ত শ্রমিকরা। আবার কেউ কেউ সেই স্তুপ থেকে বোতল, স্যালাইনের ব্যাগ, সিরিঞ্জ, বোতলের ছিপি, আরসির বোতল ভাগ করে আলাদা করে রাখছেন। আর এসব প্লাস্টিকের দ্রব্যাদি আলাদা করে মেশিনে ভেঙে তৈরি করা হচ্ছে বিভিন্ন নামের কুচি।
ডোমার উপজেলার পাঙ্গা মটুকপুরের কারখানায় কাজ করার সময় কথা হয় নারী শ্রমিক কবিতা রানীর সাথে তিনি বলেন, সকাল থেকে সারাদিন স্তূপের প্লাস্টিকের দ্রব্য বাছাই করে ভাগ করে রাখি। এরপর এসব প্লাস্টিক মেশিনের মাধ্যমে তৈরি করা হয় কুচি। সারাদিন কাজ করে মজুরী পাই মাত্র দেড়শত টাকা। তবে আগে বাড়িতে সংসারের কাজ করতাম আর বসেই থাকতাম সংসারে অনেক অভাব ছিল, স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া ঝাটি প্রায় লাগতো। বর্তমানে সংসারে অভাব নেই বললেই চলে।
বজ্রবালা রানী নামে আরেক নারী শ্রমিক বলেন, আগে সংসারে অভাব ছিলো বর্তমানে এখানে কাজ করে যা পাই তা দিয়েই আমার সংসার ভালোই চলছে।
কারখানার মেশিন অপারেটর তপন রায় বলেন, শ্রমিকরা প্লাস্টিকের পন্যগুলো ভাগ করে রাখেন, সেই সব দ্রবাদি নিয়ে এসে মেশিনে দিয়ে কুচি তৈরি করা হয়। এরপর এসব কুচি ওয়াশ মেশিনে পরিস্কারের পর রোদে শুকানো হয়। রোদে শুকানোর পর বস্তায় ভরে প্যাকেট জাত করা হয় বিক্রয়ের জন্য।
কারখানার মালিক কমল রায় বলেন, বিভিন্ন ভাংরির দোকান থেকে পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের পন্য কাচাঁমাল হিসেবে সংগ্রহ করা হয়। কুচিগুলো আমরা মিলারদের কাছে বিক্রি করে থাকি। কুচির আবার বিভিন্ন নাম রয়েছে। যেমন, আরসি বোতলগুলোর নাম পেট আর এই বোতলের কুচি যায় বিদেশে। দেশেও বিক্রি হয়ে থাকে। আর এই পেট দিয়ে দামী সূতা তৈরি হয়। মোটা প্লাস্টিক থেকে তৈরি হয় মিক্সারি। হালকা প্লাস্টিকের পন্য দিয়ে তৈরি হয় চুরি রাখার পানিহাট। হাইব্রজ দিয়ে তৈরি হয় বদনা আর পিপি দিয়ে তৈরি হয় প্লাস্টিকের দড়ি।
তিনি আরও বলেন, ইউটিউব দেখে দেখে তিনি এই কারখানা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। প্লাস্টিকের কুচি তৈরির মেশিনের দাম খুব একটা বেশি না হওয়ায় এখন অনেকেই এই কুচি তৈরির কারখানার প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন।
মিথুন রায় নামে এক ব্যবসায়ী বলেন, আমিও কুচি তৈরি কারখানা শুরু করবো কিছুদিনের মধ্যে, শুনেছি অল্প পুঁজিতে এই কারখানা দেওয়া যায়। বড় জায়গা না পাওয়ায় আপাতত শুরু করতে পারছি না তবে জায়গা পেলেই খুব তারাতারি শুরু করবো।
সৈয়দপুর উপজেলার কামারপুকুরের অশুরখাই গ্রামের শ্রমিক আতিয়া পারভীন বলেন, স্বামী মৃত্যুর পর অন্যের বাড়িতে ঝিঁয়ের কাজ করতাম। তিন সন্তানকে নিয়ে খেয়ে না খেয়ে কোনো রকমে দিন কাটত। কিন্তু এখন প্লাস্টিক বর্জ্য কারখানায় কাজ করে সংসারে সচ্ছলতা এসেছে।
সৈয়দপুর উপজেলার বাঙ্গালীপুরের কারখানার মালিক ইমরান হোসেন প্রতিবেদককে জানান, বিভিন্ন ভাংরির দোকান থেকে তারা প্লাস্টিকের পুরোনো বোতল প্রতি কেজি ২০ টাকা দরে কিনেন। এছাড়াও অন্যান্য প্লাস্টিক সামগ্রী কেনেন ৩৫ টাকা কেজি দরে তারপর এগুলো মেশিনের সাহায্যে পানি দিয়ে ওয়াশ করেন। পরে মাড়াই করে প্লাস্টিকের কুচি মেশিনের মাধ্যমে শুকিয়ে বস্তায় ভরে সরবরাহ করা হয়। সরকারি সহযোগিতা পেলে এ শিল্পের আরও প্রসার ঘটানো সম্ভব বলে নিশ্চিত করেন।
উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা নাজমুল হক বলেন, প্লাস্টিক মাটির সব থেকে বড় শত্রু। আর এই প্লাস্টিকের কারনে দিনে দিনে ফসল কমে যাচ্ছে। তিনি বলেন, এসব পরিত্যক্ত প্লাস্টিক দিয়ে কুচি তৈরি করে বিকল্প কাজে লাগায় পরিবেশের জন্য অনেক উপকার বয়ে নিয়ে আসবে। প্লাস্টিকের কুচি পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি মাটির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক ভুমিকা রাখবে বলে আশা করছি।
জেলা জনস্বাস্থ্য নির্বাহী প্রকৌশলী মুরাদ হোসেন বলেন, কুচি তৈরির কারনে মানুষজন এখন প্লাস্টিকের অব্যবহৃত পন্য ফেলে না দিয়ে সংগ্রহে রেখে বিক্রি করছে। তিনি বলেন, পরিত্যক্ত প্লাস্টিক ভেঙে প্লাস্টিকের কুচি তৈরি করায় পরিবেশের অনেক উপকার হচ্ছে। এতে করে যত্রতত্র না ফেলায় মাটির জন্য অনেক উপকার হচ্ছে অন্যদিকে পরিবেশের জন্যও স্বস্তি দায়ক বলে জানান।
এবিষয়ে রংপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক বিজন কুমার রায় বলেন, যত্রতত্র পড়ে থাকা প্লাস্টিকের দ্রব্যাদি পরিবেশের জন্য হুমকি স্বরুপ। তিনি বলেন, প্লাস্টিক সামগ্রী পঁচনশীল না হওয়ায় পরিবেশ দূষনসহ স্বাস্থ্য ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়াও এসব ফেলে দেওয়া প্লাস্টিক প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে পরিবেশ তার দূষনের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে। পাশাপাশি এসব কারখানায় কাজ করে অনেকেই স্বাবলম্বী হচ্ছেন।