মুহম্মদ রাসেল হাসান।
হুমায়ুন আহমেদ ও শৈলজারঞ্জন মজুমদার। দুজনই আমাদের নেত্র সন্তান। আজ ১৯শে জুলাই জননন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদের প্রয়াণ দিবস ও বিশ্বভারতীর সংগীত বিভাগের অধ্যক্ষ রবীন্দ্রসঙ্গীত বিশেষজ্ঞ শৈলজারঞ্জন মজুমদারের জন্ম দিবস। হুমায়ুন তাঁর লিখনীর মাধ্যমে বিশ্ব দরবারে নেত্রকোণাকে তুলে ধরেছেন, শৈলজাও বিশ্বকবির কাছে নেত্রকোণাকে অন্যভাবে তুলে ধরেছেন।
হুমায়ুন আহমেদ:
মহান এই লেখক ১৯৪৮সালের ১৩ই নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোট গল্পাকার, নাট্যকার, নাট্যনির্মাতা, গীতিকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা।
স্বাধীনতা পরবর্তী শ্রেষ্ঠ লেখকদের মধ্যে অন্যতম এই মানুষটির জীবন যাপন যেমন বিচিত্র ছিল, লেখাও তেমনি। তাঁর লেখা ছিল অত্যন্ত সহজ-সরল ভাষায়। অনেক লেখকের লেখা বুঝতে হলে আরেকজন লেখকক হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু যা বুঝতে হলে খুব বিজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই, মানে সর্বজনবোধ্য। এরফলে তাঁর বই পড়ে সাহিত্যবিমুখরাও সাহিত্যপ্রেমী হয়ে উঠে। তার লেখা শুধু এই বাংলা নয়, ওপার বাংলায়ও সমান সমাদৃত।
সমরেশ মজুমদার আনন্দ বাজার পত্রিকায় লিখেন, “কলকাতা বইমেলায় একজন লেখকের ২০০০কপি বই বিক্রি হলে তিনি বেস্ট সেলার হন। কিন্তু ৯৪এর বইমেলায় তাঁর কত বই বিক্রি হয়েছে তার হিসেব নেই। শুধু নতুন বইই ২৫হাজার কপি বিক্রি হয়েছে।” বই যে টাকা দিয়ে কিনে পড়া যায় তা তিনিই বুঝিয়েছেন বোধহয়। মিসির আলি কিংবা হিমুর মতো কিছু কাল্পনিক চরিত্রকে তিনি যেন বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। তাঁর লেখা নাটক ‘কোথাও কেউ নেই’এ বাকের ভাইয়ের ফাঁসির উপক্রম হলে সারাদেশ উত্তাল হয়ে উঠে, প্রতিবাদে নিউইয়র্কের রাজপথেও শুনলাম মিছিল বের হয়েছিল। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যার লেখা নাটকে একটি চরিত্রের ফাঁসির প্রতিবাদে বাস্তবেও দেশ উত্তাল হয়ে উঠতে পারে।
হুমায়ূন আহমেদ তিন শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর পুরো পরিবারই লেখক পরিবার বলা চলে। বড় ভাই ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালও বাংলা সাহিত্যের বরেণ্য লেখক, ছোট ভাই আহসান হাবিব কার্টুনিস্ট, তাঁর মা’ও একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। সকল শ্রেণীর মানুষ রাতবিরাতে পথে ঘাটে তাঁর গান আপন মনে গেয়ে উঠেন। তিনি লিখেছিলেন “চাঁদনী পশর রাইতে যেন মরণ হয়”। কিন্তু চাঁদনি রাত নয়, আজকের এইদিনে (২০১২সালের ১৯শে জুলাই) যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।
শৈলজারঞ্জন মজুমদার:
বিশ্বভারতীর সঙ্গীত বিভাগের অধ্যক্ষ, রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য প্রয়াত শৈলজারঞ্জন মজুমদার ১৯০০সালের ১৯শে জুলাই নেত্রকোণার মোহনগঞ্জের বাহাম গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। নেত্রকোণার দত্ত স্কুল থেকে এসএসসি পাস করে তিনি কলকাতায় চলে গিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তিন শতাধিক গানের স্মরলিপিকা।
একটি ঘটনার কথা বলি: “১৯৩২ সালে নেত্রকোনার দত্ত উচ্চ বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে জন্মবার্ষিকী পালনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। কিন্তু কালবৈশাখী ঝড়ে স্টেইজ ভেঙ্গে পড়ায় পরায় নেত্রকোনা বালিকা বিদ্যালয়ে স্থানান্তর করা হয়েছিল। কবিগুরু নেত্রকোনায় তাঁর জন্মবার্ষিকী পালন করায় বিশ্বভারতীর সঙ্গীত বিভাগের অধ্যক্ষ নেত্রকোনার শৈলজারঞ্জন মজুমদারের নিকট নিজ হাতে চিঠি লিখেছিলেন।
আরেকটা কথা মনে পড়ায় বলে ফেলি বিশ্বকবির লেখালেখি ঘাটাঘাটি করলে নেত্রকোনাকে খুব ভালোবাসার প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি শৈলজারঞ্জন মজুমদারের কাছে প্রায়ই জিজ্ঞেস করতেন, তোমাদের নেত্রকোনার নদীটার নাম কি জানি? উত্তরে যখন শৈলজা বলতেন মগড়া তখন তিনি জানতে চাইতেন মগড়া অর্থ কি?
-মগড়া অর্থ রাগী।
তখন কবিগুরু গ্রাম-বাংলার মানুষের শব্দ তৈরির প্রতিভা দেখে আশ্চর্য হতেন। বিশ্বকবির অনেক চিঠিপত্রে নেত্রকোনার কথা উঠে এসেছে। তিনি লিখেছিলেন “চোখে দেখে দেখে জানালার নাম রেখেছি নেত্রকোনা।”
১৯৩২সালে শৈলজারঞ্জন মজুমদার দীদেন্দ্রনাথের কাছ থেকে ১৪টি গান পুঁজি করে নেত্রকোনায় রবীন্দ্র জয়ন্তী পালনের প্রস্তুতি নেন। তখন অনুষ্ঠানের জন্য তখন আজকের মতো অডিটোরিয়াম, ডেকোরেশন বা বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা ছিল না। তবুও তিনি নেত্রকোনা দত্ত উচ্চ বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে তক্তা দিয়ে জোড়া দিয়ে একটি মঞ্চ তৈরি করেন। মঞ্চের পেছনে সাদা পর্দা দিয়ে কবির প্রতিকৃতি রাখা হয়। কৃষ্ণচূড়াসহ কিছু ফুল দিয়ে সাজানো হয়। হ্যাজাক বাতি দিয়ে আলোকসজ্জা করা হয়।
২৫ শে বৈশাখ সম্পূর্ণ প্রস্তুতি থাকার পরও ঝরে স্টেজ ভেঙে যায়। ফলে দুদিন পরে বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে করা হয়। তখন পর্যন্ত শান্তিনিকেতনের বাইরে উপমহাদেশেও কখনো কবির জন্মদিন পালন করা হয়নি। খবরটি ভারতের শীর্ষ পত্রিকায় ছাপানো হয়েছিল। তখনকার গোড়া মুসলিম সমাজ এমনকি হিন্দু সমাজও রবীন্দ্রনাথের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করত।
নেত্রকোনায় রবীন্দ্রনাথের জন্ম-বার্ষিকীতে কোন একজন নারী শিল্পীকে দিয়ে রবীন্দ্রনাথের একটি গান পরিবেশন করা হয়েছিল। তখন আঞ্চলিক একটি পত্রিকা “একজন নারীকে দিয়ে এই অশ্লীল গানটি পরিবেশন করে ভালো করেননি আয়োজকরা” রিপোর্ট করে বসে।
উপমহাদেশে প্রথম নেত্রকোনায় ঘটা করে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনের খবর শুনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর খুব খুশি হয়েছিলেন।
শৈলজারঞ্জন মজুমদারকে ধন্যবাদ জানিয়ে একটি চিঠি লিখেছিলেন।
চিঠিতে কবিগুরু লিখেছিলেন,
কল্যাণীয়েষু,
তোমাদের নেত্রকোনায় আমার জন্মদিনের উৎসব যেমন পরিপূর্ণ মাত্রায় সম্পন্ন হয়েছে এমন আর কোথাও হয়নি। পুরীতে একবার আমাকে প্রত্যক্ষ সভায় নিয়ে সম্মান করা হয়েছিল। কিন্তু নেত্রকোনায় আমার সৃষ্টির মধ্যে অপ্রত্যক্ষ আমাকে রূপ দিয়ে আমার স্মৃতির যে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, কবির পক্ষে সেই অভিনন্দন আরো অনেক বেশি সত্য। তুমি না থাকলে এই উপকরণ সংগ্রহ করত কে? এই উপলক্ষে বৎসরে বৎসরে তুমি আমার গানের অর্ঘ্য পৌঁছিয়ে দিচ্ছ তোমাদের পল্লীমন্দিরের ভোগম-পে- এও কম কাজ হচ্ছে না।
আমার জন্মদিন প্রতিবৎসর তোমাদের কাছে নিয়ে যাচ্ছে উৎসব- আমাকে এনে দিচ্ছে ক্লান্তির ডালিতে নতুন বোঝা। এবার পাহাড়ে এখনো দেহমনে অবসাদ আসক্ত হয়ে আছে। পৃথিবীজুড়ে যে শনির সম্মার্জনী চলেছে- বোধ হচ্ছে তার আঘাত এসে পড়বে আমার ভাগ্যে।
দেখা হলে নৃত্যকলা সম্বন্ধে মোকাবিলায় তোমার সঙ্গে আলাপ করব। ইতি ২৫। ৫। ৩৯
তোমাদের
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।”
শৈলজারঞ্জন মজুমদার ১৯৯২সালের ২৪মে পরলোকগমন করেন।
আজ ১৯শে জুলাই নেত্রকোণার দুই কৃতি সন্তান একজন কালজয়ী কথাসাহিত্যিক হুমায়ুন আহমেদ- তাঁর প্রয়াণ দিবস ও অন্যজন রবীন্দ্র সঙ্গীত বিশেষজ্ঞ শৈলজারঞ্জন মজুমদার- তাঁর জন্মদিবসে দুজনকেই গভীর শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি, তাঁদের আত্মার সতত শান্তি কামনা করছি।
লেখক: কবি মুহম্মদ রাসেল হাসান, নেত্রকোণা